দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি কি

দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কীভাবে বুঝবেন সে বিষয় নিয়েই আজকের এই ব্লগ পোস্ট। দাঁত থাকতে দাঁতের যত্ন নিতে হয় – এই প্রবাদটি নিশ্চয়ই শুনেছেন। দাঁতের মাড়িতে যদি ক্যান্সার হয়, তবে দাঁত তো আর দাঁতের জায়গায় থাকবে না, পড়ে যাবে। এছাড়াও, দাঁতের মাড়ির ক্যান্সার শুধু মাড়িতে থাকবে না, পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাবে। ক্যান্সার হচ্ছে এক মরণব্যাধি যার কারণে অসংখ্য মানুষ মারা গেছে।

তাই, ক্যান্সার যেকোনো অঙ্গেরই হোক না কেন, সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং ক্যান্সারের লক্ষণগুলো দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। তো চলুন, দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারে লক্ষণগুলো কি কি জেনে নেয়া যাক।

দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণ
দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণ

ক্যান্সার কী

ক্যান্সার হল একটি গুরুতর অসুখ যা শরীরের কোষগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি এবং বিস্তারের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। ক্যান্সার কোষগুলি স্বাভাবিক কোষ থেকে আলাদা, কারণ তারা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হয় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন এবং ছড়িয়ে পড়া শরীরের ক্ষতি করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

ক্যান্সারের কারণে এখন অব্দি অসংখ্য মানুষ মারা গেছে। ক্যান্সার হলেই এটি ধরা পড়ে না। যখন ক্যান্সার একদম শেষ পর্যায়ের দিকে চলে যায়, তখন ধরা পড়ে এবং শেষ সময়ে করার মতো আর কিছুই থাকে না।

দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সার হওয়ার কারণ

দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সার হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো তামাকের ব্যবহার। তামাকের ধোঁয়া, চিবানো তামাক, গুল, খৈনি ইত্যাদি দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তামাকের ধোঁয়া মাড়ির কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে।

অতিরিক্ত মদ্যপানও দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। মদ্যপান মাড়িতে প্রদাহ এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। এছাড়াও, নিয়মিত দাঁত ব্রাশ না করলে দাঁতের ফাকে ময়লা জমে দাঁত ক্ষয় হয় এবং সেই জায়গায় বিভিন্ন জীবাণু বাসা বাধে। সেখানে থেকেই দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সার হয়।

দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সার হলেও অনেকেই শুধু সাধারণ দাঁতের সমস্যা ভেবে থাকেন। কিন্তু, দাঁতের মাড়ি থেকে এই ক্যান্সার পুরো শরীর অব্দি ছড়িয়ে যেতে পারে। দাঁতের ব্যাথা ভেবে ভেবে অনেকেই ডাক্তারের কাছে যান না, কিন্তু এই ব্যাথা যে শুধু ব্যাথা নয় বরং ক্যান্সারের কারণে ব্যাথা তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে, এক সময় গিয়ে এই ক্যান্সার অনেক বড় রূপ ধারণ করে, যা নিরাময় করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণ

মুখে বা দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সার হলে দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণগুলো দেখ যাবে। অর্থাৎ, এমন কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে, যা দেখলে বুঝা যাবে যে আমাদের দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সার হয়েছে বা হওয়ার পথে। দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণগুলো নিচে উল্লেখ করে দিয়েছি।

১) তামাক কিংবা তামাকজাত যে কোনও পণ্য সেবন (যেমন- বিড়ি, সিগারেট, সাদা পাতা, গুল, হুঁকা, চুরুট, খইনি ইত্যাদি) এবং জর্দা, সুপারি, চুন দিয়ে পান খাওয়া। তামাকজাত পন্য সেবন বা খাওয়ার কারণে মাড়ির ক্যান্সার বেশি হয়ে থাকে।

২) অতিমাত্রায় অ্যালকোহল সেবন। অ্যালকোহল বা মদ্যপানের কারণে দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সার হয়ে থাকে। অতিরিক্ত পরিমাণে মদ্যপান করলে দাঁতের ক্ষয় হওয়া থেকে শুরু করে মাড়িতে বিভিন্ন রোগ-জীবাণু আক্রমণ করে মাড়িতে ক্যান্সারের বাসা বানিয়ে দিতে পারে। যা পরবর্তীতে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ার ঘোর সম্ভাবনা রয়েছে।

৩) ধারালো বা বাঁকা দাঁত; ত্রুটিযুক্ত ডেঞ্চার, ফিলিং, আর্টিফিসিয়াল ক্রাউন, ব্রিজ বা অ্যাপ্লায়েন্স দ্বারা মুখগহ্বরের কোনও অংশে ক্রমাগত আঘাত লাগা। আঘাত লাগার পর উক্ত স্থান পচে গিয়ে ক্যান্সার হতে পারে।

৪) সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির সরাসরি সংস্পর্শে থাকা (ঠোঁটের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়)। বেশিক্ষন সূর্যের আলোতে থাকলে বা কাজ করলে ক্যান্সার হতে পারে মুখের উপরিভাগে, অর্থাৎ ঠোঁটে।

৫) Human papilloma ভাইরাস এর সংক্রমণ এর কারনেও দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সার হতে থাকে। এই ভাইরাস থাকতে পারে এমন কোনো খাদ্য বা বস্তু মুখে নেয়ার কারণে ইনফেকশন হয়ে তা থেকে ক্যান্সার হতে পারে।

৬) বংশগত ইতিহাস থাকা। অর্থাৎ, আপনার বংশের কারও যদি মাড়ির ক্যান্সার বা যেকোনো ক্যান্সার থাকে, তবে আপনারও উক্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মাড়ির ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, ব্লাড ক্যান্সার কিংবা গলার ক্যান্সার অব্দি হতে পারে এ কারণে।

৭) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা। সাধারণত আমাদের শরীরে যখন কোনো ক্ষতিকর জীবাণু বা ভাইরাস আক্রমণ করে, তখন আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে বাধা দেয়। কিন্তু, এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি কমে যায়, তখন আর জীবাণু বা ভাইরাসকে আটকানো সম্ভব হয় না। ফলে, ক্যান্সার হয়ে থাকে।

৮) খাদ্যতালিকায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস(ভিটামিন এ, সি, ই) এর ঘাটতি। ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, এসব আমাদের দেহের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যদি ভিটামিন এর ঘাটতি পড়ে যায়, তবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলস্বরূপ, ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

উপরে উল্লিখিত এগুলোই হচ্ছে দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে বুঝতে হবে যে ক্যান্সার হয়েছে। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, দাঁতে দীর্ঘদিন যাবত ব্যাথা থাকলে বা মাড়িতে ব্যাথা থাকলে অবশ্যই হেলাফেলা করা যাবে না। ক্যান্সার হলে ব্যাথা শুরু হয়ে থাকে। এমন কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।

দাঁতের মাড়ির ক্যান্সারের চিকিৎসা

দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে চিকিৎসা নিতে হবে। কারণ, একবার মাড়িতে ক্যান্সার হলে তা পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। সঠিক সময়ে যদি ক্যান্সারের চিকিৎসা না নেয়া হয়, তবে শেষ পর্যায়ে গিয়ে মৃত্যু অব্দি ঘটতে পারে। তো চলুন, দাঁতের মাড়ির ক্যান্সারের চিকিৎসাগুলো দেখে নেয়া যাক।

দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা দিলে এবং ক্যান্সার ধরা পড়লে যেসব চিকিৎসা নিতে হবে –

১. ম্যান্ডিবুলেক্টমি: এই ক্ষেত্রে মাড়ি থেকে ক্যান্সারাস টিউমার বাদ দেওয়া হয়।

২. পার্শিয়াল ম্যাক্সিলেক্টমি: মূর্ধা অথবা উপরের মাড়িতে থাকা ক্যান্সার এই উপায়ে অপারেশন করে বাদ দেওয়া হয়।

৩. ম্যান্ডিবুলেক্টমি করতে হলে পায়ের হাড়, মূলত ফিবুলা থেকে হাড় নিয়ে মাড়ির হাড় পুনর্গঠন করা হয় মাইক্রোভাসকুলার সার্জারির মাধ্যমে।

৪. ফাইনাল প্যাথোলজি রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কেমো বা রেডিও থেরাপি হবে কিনা সেটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

মূলত এসব চিকিৎসা দেয়া হয় যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু, আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে বা আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণ দেখেই চিকিৎসা নেয়া হয়, তবে অনেক কম কষ্টেই ক্যান্সার থেকে মুক্তি মিলবে।

আমাদের শেষ কথা

ফেরদাউস অ্যাকাডেমির আজকের এই ব্লগে আপনাদের সাথে ক্যান্সার কী, দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের কারণ এবং দাঁতের মাড়িতে ক্যান্সারের লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেছি। দাঁতের মাড়ির ক্যান্সার হওয়ার পর যদি অনেক দেরিতে ধরা পড়ে, তবে রোগির মারা যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তাই, লক্ষণগুলো দেখা দিলে চিকিৎসা নিতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।

Leave a Comment