ইসলামে দাড়ি রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত-ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি বিষয়ে রয়েছে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। একজন মুসলমানের বাহ্যিক আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ ও দেহের সাজসজ্জাও ইসলামি শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত। তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— দাঁড়ি রাখা। দাঁড়ি রাখা শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্যের অংশ নয় বরং এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত এবং ইসলামী ব্যক্তিত্বের প্রতীক।
আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করবো— ইসলামে দাঁড়ি রাখার গুরুত্ব, ফজিলত, হাদীস ও ফিকহ পর্যালোচনা, দাঁড়ি না রাখার পরিণাম, এবং আধুনিক বাস্তবতায় দাঁড়ি রাখা নিয়ে ভুল ধারণা।
Also Read
দাঁড়ি রাখার ইসলামী গুরুত্ব
১. রাসূল (সা.) এর নির্দেশ
দাঁড়ি রাখা সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আদেশ। তিনি বলেছেন:
“দাঁড়ি রাখ এবং গোঁফ ছেঁটে দাও, মুশরিকদের বিরুদ্ধাচরণ কর।” — (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৮৯২)
এই হাদীসটি বোঝায় যে দাড়ি রাখা শুধু একটি সংস্কৃতি নয়, বরং এটা ধর্মীয় নির্দেশ।
২. সাহাবাদের অনুশীলন
রাসূল (সা.)-এর সাহাবীরা সকলেই দাঁড়ি রেখেছেন। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, “আমাদের কাছে দাঁড়ি কাটা জায়েয নয়।”
৩. ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠনে দাড়ির ভূমিকা
একজন মুসলমানের চেহারায় যে ইসলামী পরিচয় প্রকাশ পায়, তার অন্যতম বাহ্যিক প্রতীক হলো দাঁড়ি। এটা আত্মপরিচয়ের একটি আলামত।
দাড়ি রাখার ফজিলত
১. রাসূলের সুন্নত অনুসরণ
সুন্নত পালনের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারে। কুরআনে বলা হয়েছে:
“বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।” — (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)
২. নেক আমলের সুযোগ
দাড়ি রাখা একটি স্থায়ী আমল। এটি প্রতিনিয়ত একজন মুসলমানের জন্য সওয়াবের উৎস হতে পারে।
৩. আল্লাহর রাসূলদের অনুসরণ
সকল নবী ও রাসূলগণ দাড়ি রাখতেন। এটি নবীগণের বৈশিষ্ট্য। (সূত্র: IslamQA)
ফিকহ অনুযায়ী দাড়ির বিধান
১. চার মাযহাবের দৃষ্টিতে
- হানাফী মাযহাব: দাড়ি রাখা ওয়াজিব এবং এক মুষ্টি লম্বা না রাখলে গুনাহগার হবে।
- মালিকী মাযহাব: দাড়ি কাটা হারাম।
- শাফেয়ী মাযহাব: দাড়ি কাটাকে মাকরূহ তানযীহি বলা হয়েছে।
- হাম্বলী মাযহাব: দাড়ি রাখা ওয়াজিব।
২. এক মুষ্টি দাড়ি
ইবনে উমর (রা.) দাড়ি এক মুষ্টি বড় হলে অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন। (বুখারী)
দাড়ি রাখা কি সুন্নাত না ওয়াজিব
দাড়ি রাখা ইসলামী শরীয়তে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি সুন্নাত হিসেবে গণ্য হয়, কারণ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে দাড়ি রেখেছেন এবং সাহাবীদেরকেও দাড়ি রাখতে উৎসাহিত করেছেন। অনেক হাদীসে স্পষ্টভাবে দাড়ি রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেমন—“মুশরিকদের বিরোধিতা করো; দাড়ি বড় করো এবং গোঁফ ছাঁটো” (সহীহ বুখারী)। ফিকাহবিদদের মধ্যে হানাফি, মালিকি ও হাম্বলি মাজহাবের অধিকাংশ আলেম দাড়ি রাখা ওয়াজিব (আবশ্যক) বলেন, এবং দাড়ি কেটে ছোট করা বা সম্পূর্ণ মুন্ডানো হারাম বলেও মত দেন। অপরদিকে, কিছু শাফেয়ি আলেম এটি মুস্তাহাব বা সুন্নাতে মুঅক্কাদাহ হিসেবে মত দেন। ফলে, অধিকাংশ ইসলামিক পণ্ডিতদের মতে, দাড়ি রাখা শুধু একটি সুন্নাত নয়, বরং তা ওয়াজিবের পর্যায়ে পড়ে।
সুন্নতি দাড়ি রাখার নিয়ম
সুন্নতি দাড়ি রাখার নিয়ম ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। রাসূলুল্লাহ (সা.) দাড়ি রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন এবং তা বৃদ্ধি করার আদেশ দিয়েছেন। হাদীস অনুযায়ী, দাড়ি কাটা বা ছোট করা নিষেধ এবং এক মুষ্টি পর্যন্ত দাড়ি রাখা সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। অনেক সাহাবি দাড়ি এক মুষ্টি বড় হলে অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন, যা সহিহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। দাড়ি রাখার নিয়ম হলো: একে পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন রাখা, কাটাকাটি না করা এবং দাড়ির আকৃতি পরিবর্তন না করা। ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী দাড়ি রাখা একজন মুসলমান পুরুষের জন্য ইমানি চেতনাকে বহিঃপ্রকাশ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
দাড়ি না রাখার পরিণাম
১. সুন্নতের অবহেলা
যারা দাড়ি রাখে না, তারা রাসূলের সুন্নত থেকে বঞ্চিত হয়।
২. আত্মপরিচয়ের বিলোপ
মুসলমানের চেহারায় ইসলামী ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে দাড়ি। এটা না রাখলে ইসলামী পরিচয় হারিয়ে যেতে পারে।
৩. গোনাহের শঙ্কা
যেহেতু অনেকে দাড়ি কাটাকে হারাম মনে করেন, তাই এটা ছেড়ে দিলে গোনাহগার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
দাড়ি না রাখার শাস্তি
ইসলামী শরীয়তে দাড়ি রাখা পুরুষদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত ও ফারজের নিকটবর্তী আমল হিসেবে বিবেচিত। নবী করিম (সা.) দাড়ি রাখার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন এবং কাফেরদের অনুকরণ না করতে বলেছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “দাড়ি বাড়াও এবং গোঁফ ছেঁটো করো” (সহীহ বুখারী)। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে দাড়ি না রাখে বা একেবারে মুছে ফেলে, অনেক আলেমের মতে তারা গুনাহগার হিসেবে পরিগণিত হয়। যদিও দাড়ি না রাখার জন্য শাস্তির নির্দিষ্ট কোনো দুনিয়াবি আইন নেই অনেক দেশে, তবে আখিরাতে এর জন্য কঠিন শাস্তির আশঙ্কা রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এটি অহংকার ও ইসলামী পরিচয় লুকানোর চিহ্ন হতে পারে, যা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। তাই দাড়ি রাখা কেবল একটি বাহ্যিক রূপ নয়, বরং তা একজন মুসলমানের ঈমানদারিত্বের পরিচায়ক।
দাড়ি না রাখলে কি গুনাহ হবে?
ইসলামের দৃষ্টিতে দাড়ি রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত, যা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পালন করেছেন এবং তাঁর উম্মতের জন্য তা অনুসরণযোগ্য হিসেবে নির্দেশ দিয়েছেন। অনেক ইসলামিক বিদ্বান মত দেন যে দাড়ি কাটা বা দাড়ি না রাখা গুনাহের কাজ হতে পারে, বিশেষ করে যদি তা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়। হাদীস অনুযায়ী, রাসূল (সা.) বলেছেন, “দাড়ি বাড়াও এবং গোঁফ ছেঁটে দাও,” (বুখারী ও মুসলিম)। এই হাদীসের ভিত্তিতে অধিকাংশ ফিকহ বিশারদগণ মনে করেন, পূর্ণ দাড়ি রাখা ও তা কাটাছেঁড়া না করা ওয়াজিব বা আবশ্যক। তবে, কারও যদি বিশেষ কারণ থাকে এবং সে অন্তরে দাড়ির গুরুত্ব স্বীকার করে, তাহলে তা আল্লাহর উপর নির্ভর করে — তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু। অর্থাৎ, ইচ্ছাকৃতভাবে সুন্নতের অবহেলা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
আধুনিক সমাজে দাড়ি রাখা নিয়ে ভুল ধারণা
১. দাড়ি মানেই উগ্রতা নয়
অনেকে মনে করেন দাড়িওয়ালা মানুষ মানেই কট্টরপন্থী। অথচ রাসূল (সা.) ছিলেন দাড়িওয়ালা এবং তিনি ছিলেন সকলের জন্য রহমত।
২. চাকরির ক্ষেত্রে বাধা?
আধুনিক অনেক প্রতিষ্ঠান এখন দাড়িকে বৈচিত্র্য ও ব্যক্তিত্ব হিসেবে মেনে নিচ্ছে। এমনকি পশ্চিমা দেশেও দাড়ি এখন ফ্যাশনের অংশ।
৩. পরিচ্ছন্নতা ও দাড়ি
দাড়ি পরিচ্ছন্নভাবে রাখা সুন্নত ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও স্বাস্থ্যকর। গবেষণায় দেখা গেছে, দাড়িতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকে (BBC Health)।
ইসলামে দাড়ি রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত-প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: দাড়ি রাখা কি ইসলামে বাধ্যতামূলক?
উত্তর: অধিকাংশ আলেমদের মতে এটি ওয়াজিব বা ফরজের নিকটবর্তী।
প্রশ্ন ২: দাড়ি কতটুকু লম্বা রাখা উচিত?
উত্তর: কমপক্ষে এক মুষ্টি পরিমাণ দাড়ি রাখা উচিৎ। অতিরিক্ত হলে ছাঁটা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৩: দাড়ি না রাখলে কি গোনাহ হবে?
উত্তর: অনেক ফকীহগণ একে গোনাহ মনে করেন। তাই সুন্নত পালনে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
প্রশ্ন ৪: চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা হলে কী করবো?
উত্তর: অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাড়ি এখন চাকরির ক্ষেত্রে বাধা নয়। যদি হয়, তবে বিকল্প চাকরি খুঁজার চেষ্টা করতে হবে, কারণ দ্বীনকে অগ্রাধিকার দেওয়া উত্তম।
ইসলামে দাড়ি রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত- শেষ কথা
ইসলামে দাড়ি রাখা শুধু বাহ্যিক রূপের পরিবর্তন নয়; এটি একটি আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক পরিচয়ের অংশ। রাসূল (সা.) এর সুন্নতের অনুসরণে দাড়ি রাখা ঈমানদারের আত্মার প্রশান্তির কারণ হতে পারে।
আমরা যেন এই সুন্নতকে শুধু বাহ্যিক রূপে নয় বরং অন্তরের অন্তঃস্থলে ধারণ করি। দাড়ি রাখার মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারেন।