আকিকার নিয়ম ও দোয়া-নবজাতক শিশুর জন্ম প্রতিটি পরিবারে একটি আনন্দদায়ক এবং আশীর্বাদপূর্ণ ঘটনা। ইসলামে এই বিশেষ উপলক্ষে একটি সুন্দর সুন্নত রয়েছে, যাকে বলা হয় “আকিকা”। এটি একটি ইসলামিক রীতি যা নবজাতকের জন্ম উপলক্ষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য পালন করা হয়। আকীকা শুধু একটি দান বা উৎসব নয়, এটি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং নবজাতকের মঙ্গল কামনা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
এই ব্লগে আমরা জানবো আকিকার সঠিক নিয়ম, করণীয়, নিষেধ, এবং আকিকার সময় যে দোয়া পড়তে হবে তা জানব। চলুন শুরু করা যাক-
Also Read
আকিকা কী?
আকীকা হল একটি নির্দিষ্ট পশু কোরবানির মাধ্যমে নবজাতক শিশুর পক্ষ থেকে দোয়া করা এবং দান করার একটি সুন্নত রীতি। এটি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি সুন্নাত এবং তিনি নিজেই তাঁর নাতি হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা.)-এর জন্য আকিকা করেছেন।
আকিকা শব্দের অর্থ কি?
যখন একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে, তখন একটি পশু কোরবানি করা এবং তার গোশত বন্ধু, আত্মীয়স্বজন এবং সমাজের অভাবী সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সুন্নত। একে আকীকা বলা হয় এবং ইসলামে এটি একটি পুণ্যময় কাজ।
আকিকার জন্য নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বা সময় কুরআনে উল্লেখ নেই, তবে হাদীসের আলোকে:
নবী (সা.) বলেছেন: “শিশু জন্মের সপ্তম দিনে তার আকিকা করো…” (আবু দাউদ: ২৮৩৮)
অর্থাৎ শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করা সুন্নাত। তবে এটি সম্ভব না হলে ১৪ তম, ২১ তম বা পরে করাও জায়েজ আছে।
আকিকার নিয়ম
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আকিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সন্তানের আকিকা করার নিয়ত করে, সে যেন তা পালন করে, ছেলের জন্য সমান মূল্যের দুটি ছাগল এবং একটি মেয়ের জন্য। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৯৬১)
হজরত মুহাম্মদ (স.) সপ্তম দিনে তাঁর নাতি হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-এর আকিকা করেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ২৮৩৪)
এ ছাড়াও সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করার কথা জামে তিরমিজির ১৫২২ নম্বর হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই সম্ভব হলে সপ্তম দিনেই আকিকা করা শ্রেয়।
তবে কোনো কারণবশত সপ্তম দিনে আকিকা করা সম্ভব না হলে ১৪তম দিন বা ২১তম দিনেও করা ভালো।
এ প্রসঙ্গে উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, “আকীকা সপ্তম দিনে করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ১৪তম দিনে। যদি তাও সম্ভব না হয়, তাহলে ২১তম দিনে।” (মুসতাদরাকাহ হাকীম, হাদীস নং ৭৬৬৯) আর আকীকা ২১ দিনের মধ্যে না করলে পরবর্তী সময়ে সুবিধাজনক সময়ে করা যাবে।
স্বাভাবিকভাবে সন্তানের আকিকা করার দায়িত্ব তার জন্মদাতা বাবার। অবশ্য অন্য কেউ বা নিজেও নিজের আকিকা করতে পারবেন।
আকিকার পশুর চামড়া : আকিকার পশুর চামড়া বাজারে বিক্রি করে, বিক্রিয়কৃত টাকা গরিব-মিসকিনের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে।
আকিকার দোয়া
الله حجيي أكيكاتو ابن فولانين دموهابيداميهي ولحموها بلاحميها وعظمها بيازمها وزيلدوها بزلاديهي وشا روحها بشري الله الله ، الله فيدا علي ابن مينار
উচ্চারণ
আল্লাহুম্মা হাজিহি আকিকাতু ইবনি ফুলানিন দামুহাবিদামিহি ওয়া লাহমুহা বিলাহমিহি ওয়া আজমুহা বিআজমিহি ওয়া জিলদুহা বিজিলাদিহি ওয়া শা রুহা বিশাররিহি আল্লাহুম্মাজআলহা ফিদাআল্লি ইবনি মিনান্নার।
আকিকার গোস্ত খাওয়ার নিয়ম?
আকীকা করার পর গোশত আত্মীয়-স্বজন, গরীব, অসহায়, অভাবী ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করার পর কিছু গোস্ত তারা নিজেদের জন্য রেখে খেতে পারবে।
আর যদি সন্তান বড় হয়ে যায় এবং তারপর সেই সন্তানের আকীকা করা হয়, তাহলে সেই সন্তানও তার আকীকার গোশত সে নিজে খেতে পারবে।
আকিকার গোশত বন্টনের নিয়ম
আকিকার গোশত নিন্মরুপ ভাবে বন্টনের নিয়ম রয়েছে:
-
আকিকার গোশত নিজে খাওয়া, আত্মীয়-স্বজনকে খাওয়ানো এবং গরীবদের মাঝে বিতরণ করা সুন্নাত।
-
কোরবানির গোশতের মত এক-তৃতীয়াংশ করে ভাগ করার নিয়ম এখানে নেই, তবে সদকা করা উত্তম।
আকিকার জন্য ছাগলের বয়স?
ছাগল দিয়ে আকিকার নিয়ম ও দোয়া সম্পর্কে ইতোমধ্যে আমাদের ব্লগে ইতিপূর্বে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে, আপনারা চাইলে সেই পোষ্টটি পড়ে আসতে পারেন। পাশাপাশি আপনাদের আরও একটি বিষয় জানা খুবই দরকার। তা হলো আকিকার জন্য ছাগলের বয়স কত হতে হবে।
আকিকার জন্য ছাগলের বয়স কমপক্ষে এক বছর হতে হবে। এক বছর পার হওয়ার পরে সেই ছাগল আকিকার জন্য নির্বাচন করা উত্তম।
আকিকার গুরুত্ব ও ফজিলত
- শিশুর জন্য বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা।
- শয়তানের প্রভাব থেকে নিরাপত্তা।
- পরিবারে শান্তি ও কল্যাণের বার্তা।
- শিশুর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
আকিকা না করলে কি গুনাহ হয়?
না, আকিকা না করলে গুনাহ হয় না। তবে এটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, অর্থাৎ নবীজি (সা.) গুরুত্বের সাথে পালন করেছেন, তাই সাধ্য থাকলে করাই উত্তম। সামর্থ্য না থাকলে আল্লাহর কাছে দোয়া করাই যথেষ্ট।
আকিকার নিয়ম ও দোয়া – প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন-১: কন্যা সন্তানের জন্য আকিকা করা কি সুন্নাত?
উত্তর: হ্যাঁ। যদিও অনেক সমাজে ছেলেদের জন্য গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়, ইসলামে মেয়ের জন্যও আকিকা সুন্নাত।
প্রশ্ন-২: ৭ দিন পরে আকিকা করলে কি সমস্যা?
উত্তর: না। পরে করলেও আকিকার সওয়াব পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন-৩: একাধিক সন্তানের আকিকা একসাথে করা যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ। একসাথে একাধিক শিশুর আকিকা করা যায়, সমস্যা নেই।
প্রশ্ন-৪: আকিকার মাংস দিয়ে কি নিজেরা খেতে পারি?
উত্তর: হ্যাঁ। নিজেরা খেতে পারেন, পরিবার, আত্মীয় এবং গরিবদের খাওয়ানোও উত্তম।
প্রশ্ন-৫: আকিকা না করলেও কি শিশুর ক্ষতি হয়?
উত্তর: না। এটি সুন্নাত, ফরজ নয়। তবে করাটা কল্যাণজনক।
আকিকার নিয়ম ও দোয়া- শেষ কথা
আকিকা হল ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত যা নবজাতকের জন্য আশীর্বাদ নিয়ে আসে। এটি সন্তানের প্রতি দায়িত্বের একটি অংশ এবং সমাজ ও পরিবারের প্রতি একজনের দায়িত্ব পালনের প্রতীক। আকিকার মাধ্যমে আমরা সন্তানের জন্য প্রার্থনা করি, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং গরীবদের সাহায্য করি। আকীকা শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি ইবাদত, যা সঠিকভাবে পালন করলে অনেক বরকতের দরজা খুলে যায়।
আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর প্রিয় সুন্নাহগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করার এবং আমাদের সন্তানদের রক্ষা করার তাওফীক দান করুন। যারা নতুন বাবা-মা হয়েছেন, তাদের জন্য আকিকা একটি সুন্দর এবং বরকতময় সুচনা হতে পারে।
আরও পড়ুন:
▷ছাগল দিয়ে আকিকার নিয়ম
▷গরু দিয়ে আকিকা দেওয়ার নিয়ম