পিরিয়ডের পর ফরজ গোসলের নিয়ম-ইসলামে পিরিয়ড (ঋতুস্রাব) শেষ হওয়ার পর নারীদের জন্য ফরজ গোসল করা আবশ্যক। এই গোসলের মাধ্যমে তারা পবিত্রতা অর্জন করে নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত পুনরায় শুরু করতে পারেন। নিম্নে পিরিয়ডের পর ফরজ গোসলের সঠিক নিয়ম, প্রয়োজনীয় দোয়া, এবং গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো।
পিরিয়ডের পর ফরজ গোসলের নিয়ম । period er por foroj gosoler niyom
পিরিয়ড শেষে ফরজ গোসলের জন্য নিম্নোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করা উচিত:
Also Read
- নিয়ত করা: গোসলের শুরুতে মনে মনে নিয়ত করুন যে আপনি পিরিয়ডের অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য গোসল করছেন।
- বিসমিল্লাহ বলা: গোসল শুরু করার আগে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ পড়ুন। যদি আপনি এমন স্থানে থাকেন যেখানে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ, তবে মনে মনে পড়তে পারেন।
- হাত ধোয়া: দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
- লজ্জাস্থান পরিষ্কার করা: বাম হাত দিয়ে লজ্জাস্থান এবং আশেপাশের অংশ ভালোভাবে ধুয়ে নিন। যদি সন্দেহ হয় যে লজ্জাস্থানের ভেতরে কোনো অপবিত্রতা রয়ে গেছে, তবে তা পরিষ্কার করুন।
- অজু করা: নামাজের জন্য যেভাবে অজু করা হয়, সেভাবে সম্পূর্ণ অজু করুন। তবে পা ধোয়া শেষে রাখা যেতে পারে, যা গোসলের পর ধোয়া হবে।
- চুল ভিজানো: মাথার চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছাতে হবে। চুল খুলে ফেলতে হবে না, তবে নিশ্চিত হোন যে পানি চুলের গোড়ায় পৌঁছেছে।
- শরীরে পানি ঢালা: প্রথমে তিনবার মাথায় পানি ঢালুন, তারপর ডান কাঁধে তিনবার, এরপর বাম কাঁধে তিনবার পানি ঢালুন। এরপর পুরো শরীরে পানি ঢেলে নিশ্চিত করুন যে শরীরের কোনো অংশ শুকনো না থাকে।
- পা ধোয়া: গোসলের স্থান থেকে সরে এসে পা দুটো ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ফরজ গোসল সম্পন্ন হবে এবং আপনি পবিত্রতা অর্জন করবেন।
ফরজ গোসলের প্রয়োজনীয়তা
পিরিয়ডের পর ফরজ গোসল করা আবশ্যক, কারণ এটি ইসলামের বিধান। হাদিসে এসেছে, এক নারী রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি কীভাবে পিরিয়ডের পর গোসল করবো?” তিনি বললেন, “একটি সুগন্ধিযুক্ত কাপড় নাও এবং তা দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করো।” (সহিহ বুখারি: ৩১৫)
পিরিয়ডের পর ফরজ গোসলের দোয়া
গোসলের নির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই, তবে গোসলের আগে নিম্নোক্ত দোয়া পড়া যেতে পারে:
নিয়তের দোয়া: “নাওয়াইতুল গুসলা লিরাফইল হাদাসিল আকবারি মিনাল হায়দি লিল্লাহি তা‘আলা“
অর্থ: আমি আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে পিরিয়ডের অপবিত্রতা দূর করার জন্য গোসল করার নিয়ত করছি।
পিরিয়ডের পর ফরজ গোসলের ক্ষেত্রে সতর্কতা
- চুল ও অলংকার: মহিলাদের চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছাতে হবে। কানে বা হাতে অলংকার থাকলে সেগুলো নাড়িয়ে পানি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
- নখের পলিশ: নখে নেইল পলিশ থাকলে তা উঠিয়ে ফেলতে হবে, কারণ এটি পানি পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে।
- শরীরের ভাঁজ: নাভি, বগল, কুঁচকি ইত্যাদি স্থানে পানি পৌঁছানো নিশ্চিত করুন।
নারীর ফরজ গোসলের নিয়ম
নারীর ফরজ গোসলের নিয়ম ইসলামি শরিয়তে নির্ধারিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যখন কোনো নারী হায়েজ (ঋতুস্রাব) বা নিফাস (সন্তান জন্মের পর রক্তস্রাব) শেষ করেন অথবা স্বামী সহবাস করেন, তখন তার জন্য ফরজ গোসল করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। গোসলের নিয়ম হলো—প্রথমে নিয়ত করতে হবে, তারপর উভয় হাত কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নিতে হবে এবং পবিত্রতা অর্জনের জন্য পুরো শরীরে পানি পৌঁছানো বাধ্যতামূলক। প্রথমে গোপন অঙ্গ ধুয়ে নিতে হয়, তারপর পূর্ণরূপে অজু করতে হয়, এবং পরে মাথা থেকে শুরু করে ডান পাশ, তারপর বাম পাশ এবং পুরো শরীরে পানি ঢালতে হয় যেন কোনো অঙ্গ শুকনো না থাকে। ফরজ গোসল ছাড়া নামাজ, তাওয়াফ, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদত করা বৈধ নয়। তাই ফরজ গোসলের নিয়ম জানা ও তা সঠিকভাবে পালন করা প্রতিটি নারীর জন্য আবশ্যক।
পিরিয়ডের পর পবিত্র হওয়ার নিয়ম
পিরিয়ড (ঋতুস্রাব) শেষ হওয়ার পর ইসলামি শরিয়তে পবিত্র হওয়ার একটি নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। পিরিয়ড পুরোপুরি শেষ হলে নারীদের অবশ্যই গোসল করতে হয়, যাকে “গোসলে জানাবাত” বলা হয়। এই গোসলের জন্য নিত্য গোসলের নিয়ম অনুসরণ করে পুরো শরীর ভালোভাবে পানি দিয়ে ধৌত করতে হয়, যাতে শরীরের কোনো অংশ শুকনো না থাকে। নখ, চুল, ও গোপন অঙ্গসহ সব জায়গা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয়। এই গোসলের পরই নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, রোজা রাখা ও অন্যান্য ইবাদত করা বৈধ হয়। তাই পিরিয়ডের পর পূর্ণ পবিত্রতা অর্জনের জন্য নিয়ম অনুযায়ী গোসল করা ফরজ।
ফরজ গোসলের নিয়ম হাদিস
ইসলামে ফরজ গোসলের নিয়ম হাদিসের আলোকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যখন কেউ গোসল করে, সে যেন সমস্ত শরীর ধুয়ে ফেলে এবং ভালোভাবে পানি পৌঁছায়” (সহিহ মুসলিম)। ফরজ গোসলের জন্য প্রথমে নিয়ত করা জরুরি, এরপর সমস্ত শরীরে পানি পৌঁছানো এবং মুখসহ পুরো শরীর ধৌত করা ফরজ। হাদিস অনুযায়ী, গোসলের সময় তিনটি বিষয় ফরজ: (১) নিয়ত করা, (২) কুলি করা ও নাকে পানি পৌঁছানো, এবং (৩) সম্পূর্ণ শরীর ধৌত করা। নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য। বিশেষ করে হায়েয ও জানাবতের পরে গোসল ফরজ হয়, এবং এটি আদায় না করলে নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত সহিহ হয় না। হাদিসের আলোকে এই বিধান ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য।
মাসিকের পর ফরজ গোসল না করে সহবাস করা যাবে?
মাসিক (ঋতুস্রাব) শেষ হওয়ার পর ফরজ গোসল না করে সহবাস করা ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ تعالى স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যে, নারীরা মাসিককালীন অবস্থায় অপবিত্র থাকে এবং যখন তারা পবিত্র হবে (অর্থাৎ গোসল করবে), তখনই তাদের সাথে সহবাস করা বৈধ হবে (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২২২)। তাই মাসিক শেষ হওয়ার পর নারীর ফরজ গোসল না করা পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হারাম। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী, পবিত্রতা রক্ষা করা ইমানের অঙ্গ এবং তা লঙ্ঘন করা গুরুতর গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং সহবাস করার আগে অবশ্যই ফরজ গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করতে হবে।
মাসিকের পর ফরজ গোসল না করে রোজা রাখা যাবে কিনা?
মাসিক শেষ হওয়ার পর ফরজ গোসল না করে রোজা রাখা জায়েজ নয়। ইসলামী শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো নারী মাসিক বা নেফাস (বাচ্চা হওয়ার পর রক্তপাত) শেষ হওয়ার পর ফরজ গোসল না করলে সে নামাজ ও রোজা আদায় করতে পারে না। রোজা রাখার পূর্বশর্ত হলো পবিত্রতা, এবং মাসিকের পর গোসলের মাধ্যমে ওই পবিত্রতা অর্জিত হয়। তাই গোসল না করে রোজা শুরু করলে রোজাটি শুদ্ধ হবে না, এবং পরে সেই রোজা কাযা করতে হবে। সুতরাং, মাসিক শেষ হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব ফরজ গোসল করে নেওয়া উচিত, যেন ইবাদত যথাযথভাবে পালন করা যায়।
পিরিয়ডের পর ফরজ গোসলের নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন–উত্তর
প্রশ্ন ১: পিরিয়ড শেষে অসুস্থতার কারণে গোসল করতে অক্ষম হলে কী করা উচিত?
উত্তর: যদি কেউ অসুস্থতার কারণে গোসল করতে অক্ষম হয়, তবে তিনি তায়াম্মুম করতে পারেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা যদি অসুস্থ হও অথবা সফরে থাক, যদি তোমাদের কেউ মলত্যাগ করে আসে অথবা যদি স্ত্রী সহবাস কর তারপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি নাও এবং তোমাদের মুখ ও হাত তা দিয়ে মাসেহ কর।” (সূরা মায়েদা: ৬)
প্রশ্ন ২: গোসলের সময় চুল খুলে ফেলতে হবে কি?
উত্তর: না, চুল খুলে ফেলতে হবে না, তবে নিশ্চিত করতে হবে যে পানি চুলের গোড়ায় পৌঁছেছে।
প্রশ্ন ৩: গোসলের পর কি পুনরায় অজু করতে হবে?
উত্তর: গোসলের সময় যদি পূর্ণ অজু করা হয় এবং অজু ভঙ্গের কোনো কারণ না ঘটে, তবে পুনরায় অজু করার প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন ৪: নখে নেইল পলিশ থাকলে গোসলের হুকুম কী?
উত্তর: নখে নেইল পলিশ থাকলে গোসলের হুকুম নিয়ে ইসলামী শরিয়তে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। গোসলের সময় শরীরের প্রতিটি অংশে পানি পৌঁছানো ফরজ, এবং কোনো কিছু যদি পানির পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে, তবে সেই গোসল সহিহ হয় না। নেইল পলিশ সাধারণত এমন একটি স্তর তৈরি করে যা নখে পানির পৌঁছাতে বাধা দেয়। তাই যদি একজন ব্যক্তি নেইল পলিশ লাগানো অবস্থায় গোসল করেন, তবে তার গোসল সহিহ হবে না, কারণ পানি নখে পৌঁছায়নি। একারণে গোসল করার আগে নেইল পলিশ সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলা আবশ্যক, যাতে শরীরের প্রতিটি অংশে পানি পৌঁছাতে পারে এবং গোসল সহিহ হয়।
পিরিয়ডের পর ফরজ গোসলের নিয়ম সম্পর্কে শেষ কথা
পিরিয়ডের পর ফরজ গোসল ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। সঠিক নিয়মে গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম নারীর জন্য আবশ্যক। উপরোক্ত নির্দেশনা অনুসরণ করে ফরজ গোসল সম্পন্ন করলে আপনি পবিত্রতা অর্জন করে ইবাদত-বন্দেগি করতে সক্ষম হবেন।
আরও পড়ুন:
▷ফরজ গোসলের নিয়ম ও নিয়ত
▷ গোসল ফরজ হওয়ার কারণ
▷ গোসলের ফরজ কয়টি ও কি কি?
▷ ফরজ গোসল না করতে পারলে করণীয়